টুনটুনিকে দেখলাম বারান্দায় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ৫ বছরের ভাগ্নি টুনটুনির মন খারাপ জেনে আমারও মন খারাপ। এটাই স্বাভাবিক। কাছাকাছি গিয়ে মন খারাপের কারণ জানতে চাইলাম। কারণ জানার পর আমার মনের সাথে সাথে মাথাও খারাপ হবার অবস্থা। টুনটুনি বলল, “আব্বু -আম্মুর বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে আমার খুব মন খারাপ করছে। সবাই আব্বু-আম্মুকে নিয়ে ব্যাস্ত। আমার দিকে কারো নজর নাই। আমি খাটের নিচে লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখেছি।” কেন আমার মাথা খারাপ হয়েছে বুঝেছেন এবার?
ধরা যাক, আপনার ছোট্ট শিশুটি কেবলই বাক্য তৈরি করতে শিখেছে। একদিন বাসায় ফিরে দেখলেন বসার ঘরের ফুলদানিটা ভেঙ্গে পড়ে আছে। আপনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন এটা কীভাবে হয়েছে? সে হয়তো বলবে আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন আমার সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙ্গেছে অথবা শয়তানের সাথে স্পাইডারম্যানের যুদ্ধ হচ্ছিল তখন ফুলদানি পড়ে ভেঙ্গে গেছে। বেশিরভাগ বাচ্চা পরেরটা বলে থাকে। এখন প্রশ্ন সে এটা কোথায় শিখল? আপনি নিশ্চয় শেখাননি। বাচ্চাকে অংক, ইংরেজি, বিজ্ঞান শেখানো হয় কিন্তু গল্প বলা শেখানো হয়না। শিশু জন্মের পর থেকেই গল্পের মধ্যে দিয়ে বড় হতে থাকে। Acts of Meaning বইতে Psychologist Jerome Brurer বলেছেন, গল্প খোঁজা, গল্পের অর্থ খোঁজা এসব বিষয় আমাদের জন্মের আগে আমাদের মাথার মধ্যে প্রোগ্রামিং করা থাকে।
এ কারণেই আমরা প্রত্যেকেই গল্প শুনতে পছন্দ করি। এটা হতে পারে কোন উপন্যাস, ছোট গল্প, সিনেমা অথবা পরিচিত কারো বলা গল্প। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমনটি কেন হয়? বিষয়টি আসলে খুব সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। যখন আমরা কোন পাওয়ার পয়েন্ট দেখি বা বোরিং বুলেট পয়েন্ট দেখি তখন আমাদের নির্দিষ্ট কিছু অংশ (যা খুব সামান্য) সক্রিয় হয়ে উঠে। বিজ্ঞানীরা এই অংশটির নাম দিয়েছেন Broca’s area and Wernicke’s area। এটা আমাদের ব্রেইনের ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং অঞ্চল পর্যন্ত যেতে পারে। এ অংশের মাধ্যমে আমরা যেকোনো শব্দের অর্থ খুঁজে থাকি। এ পর্যন্ত কাজ করার পর আর কিছুই হয়েনা।
কিন্তু আমরা যখন গল্প শুনে থাকি তখন পুরো ঘটনায় বদলে যায়। গল্প শুনলে আমাদের ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (Language Processing Area) অঞ্চলই শুধু কাজ করা শুরু করেনা বরং আমাদের ব্রেইনের অনেক অংশ কাজ করা শুরু করে। কেউ যখন খুব সুস্বাদু খাবারের কথা বলে তখন আমাদের ব্রেনের সেন্সরি কর্টেক্স (sensory cortex) জ্বলে উঠে। আবার আমরা যদি চলমান কিছুর বর্ণনা শুনে থাকি তখন আমাদের মটর কর্টেক্স (motor cortex) কাজ করতে শুরু করে। গল্প বলার এবং শোনার সময় বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে একটা দারুণ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। দুজনের ব্রেইনের সবগুলো অংশ সমানভাবে কাজ করে।
গল্প এবং ব্রেইনের আন্তসম্পর্ক বোঝার জন্য বিগত কয়েক দশক থেকে Cognitive Science, Neurological Science, Evolutionary Biology, Development Psychology, Neural net Modelling ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বিজ্ঞান এখন এতোটাই এগিয়েছে যে মানুষের ব্রেইনের প্রতিটি কোষ এখন আলাদা আলাদাভাবে মনিটর করা যায়। Kendal Haven তার দ্বিতীয় বইয়ে (Story Smart: Using the Science of Story to Persuade, Influence and Inspire) দারুণ একটা বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্রেইন যেকোনো তথ্যকে গল্পে রূপান্তর করে। এটা তার নিজের তৈরি করা গল্প। যেসব তথ্য সে পেয়েছে সেগুলো না। আমাদের চারপাশে যেসব তথ্য, উপাত্ত, যুক্তি, বিশ্লেষণ পাইনা কেন সরাসরি সেটা ব্রেইনে জমা হয়ে যায়না। প্রথমে ব্রেইন এটাকে গল্পে পরিণত করে তারপর অন্য কিছু।”
গত শুক্রবারের সংবাদপত্রের হেডলাইন আপনার মনে আছে? গত পরশুদিনেরটা? মনে পড়ছেনা? কিন্তু হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার কথা আপনার ঠিক মনে আছে। সে সময় আপনি কোথায় ছিলেন, কার কাছ থেকে খবর পেয়েছিলেন, আপনার সাথে কে বা কারা ছিল সব কিন্তু আপনার মনে আছে। ভীষণ রকম ইমোশোনালি চার্জড একটি ঘটনা ঘটার সময় আমাদের ব্রেইনে Amygdala থেকে Dopamine নিঃসৃত হয়। এটা একজনের মগজে Pest-It Note এর মত আটকে যায়। স্থায়ী হয়ে যায়। সহজে ভুলা যায়না। এমনকি কয়েক দশক পরেও আপনি অবিকল বলতে পারেন।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের Uri Hasson ল্যাবে একটি গবেষণা চলছে। এখানে অন্ধকার একটা ঘরে ৫ জন শুয়ে আছে। প্রত্যেকের ব্রেইন স্ক্যান করা হচ্ছে Functional Magnetic Resonance Imaging ( fMRI) মেশিনের মাধ্যমে। আর আছেন জিম ও গ্রাডি নামে একজন বিখ্যাত স্টোরি টেইলার। তার ব্রেইনও স্ক্যান করা হচ্ছে একসাথে। অন্ধকার রুমের মধ্যে জিম গল্প বলা শুরু করলেন। মজার ঘটনা ঘটল। জিম এর ব্রেইনের প্যার্টানের সাথে অন্য ৫ জনের ব্রেইনের প্যার্টান Synchronize and Lock হয়ে যাচ্ছে। এটাই হলো Neural Coupling। জিম গল্প বলা বন্ধ করলেই Synchronize হওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে জিম এর গল্পটি রেকর্ড করে অন্যদের শোনানো হয়েছে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে Neural Coupling হয়নি।
এ গবেষণায় আরেকটি বিষয় খুব লক্ষণীয়। সেটা হলো গল্প বলা ও শোনার সময় বক্তার চেয়ে শ্রোতার ব্রেইনের প্যার্টান বেশি কাজ করছে বা বেশি Dopamine নিঃসৃত হচ্ছে। বক্তা কিছু বলার আগেই শ্রোতা অনুমান করতে থাকে এরপর কী হবে। সিনেমা দেখার সময় বা গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় আমরা অনেক সময় কল্পনা করতে থাকি বা অনুমান করতে থাকি। এ ধরনের কল্পনা বা অনুমান যত বেশি হবে বিষয়বস্তু তত সহজ হবে এবং মনে থাকবে।
গল্প নিয়ে অনুমান নির্ভর জনপ্রিয় ধারণাগুলো হল, গল্প শিশুদের, গল্প মানেই কাল্পনিক, গল্পের মধ্যে সিরিয়াস কিছু নাই ইত্যাদি। আসলে কি তাই? দুনিয়াব্যাপী নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পণ্ডিতগণ সনাতন গল্প বলার রীতিতেই আস্থা রেখেছেন। আপনিও আস্থা রাখুন।