অনেক দিন আগের কথা। একদল যোদ্ধা গত কয়েক মাসে অসংখ্য যুদ্ধ জয় করে ফিরেছেন। ধরা যাক, তারা ফিরছেন দক্ষিণ দিক থেকে। তাদের নেতৃত্বে আছেন একজন মহান সেনাপতি। আবার উত্তর দিক থেকেও আরেকদল যোদ্ধা একজন গ্রেট সেনাপতির নেতৃত্বে ফিরছেন। তারাও অনেক যুদ্ধ জয় করেছেন। দুইদল যোদ্ধা মুখোমুখি। এর আগে তাদের মধ্যে কখনও যুদ্ধ হয়নি। এক সময় যুদ্ধ শুরু হলো। সে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। দুপক্ষের দুজন সেনাপতি ছাড়া সকলে মারা গেলেন। চারিদিকে দুপক্ষের সৈন্যদের মৃতদেহ, শত শত ঘোড়ার লাশ এলোমেলো পড়ে আছে। দুজন সেনাপতিই ক্লান্ত। দুজনেই জানেন এ যুদ্ধে একজন ঘরে ফিরে যাবে। সন্ধ্যায় তারা সিদ্ধান্ত নিলেন আজকের মত যুদ্ধ বিরতি। সকালে আবার শুরু হবে চূড়ান্ত যুদ্ধ।
সূর্য ডুবে গেছে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। আকাশ ভরা তারা। দুজন সেনাপতি মুখোমুখি বসে আছেন। তাদের মাঝখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তাদের একজন অন্যজনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, “বহুদিন আমি আমার স্ত্রী, সন্তানকে ঘরে রেখে এসেছি। এবার ঘরে ফিরে তাদের নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবো।” দ্বিতীয়জন বলে উঠলেন, “তুমি ঘরে ফিরে যেতে পারবেতো? এখান থেকে শুধু আমিই ফিরে যাবো। বাড়ি গিয়ে আমার মেয়েকে ছবি আঁকা শেখাবো, বাবা মাকে নিয়ে নানা দেশ ঘুরতে যাবো।” প্রথমজন বলে উঠলেন, “কাল সকালে যে যুদ্ধ হবে সেখানি আমিই জয়ী হবো। আমি ফিরে গিয়ে আমার পরিবারের কাছে গত কয়েক মাসের গল্প শুনাবো।” দুজন এভাবে সারারাত নিজেদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে গল্প করতে থাকলেন। যেন কতদিনের পরিচিত! গল্পে গল্পে কখন যে ভোর হয়ে গেছে কারো খেয়াল নাই। চুক্তি অনুযায়ী কিছুক্ষণের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হবার কথা। মজার বিষয় হলো, তাদের দুজনের হাত নিজ নিজ তরবারি পর্যন্ত যাচ্ছে কিন্তু কেউই তরবারি বের করতে পারছেননা। কারণ তারা একজন আরেকজনের গল্প শুনেছে। যখন একজন আরেকজনের গল্পটা জানবে তখন তারা আর লড়াই বা ঘৃণা করতে পারবেননা। আপনি যদি কারো গল্প জেনে থাকেন তবে তার সাথে আপনি আর ফাইট করতে পারবেন না। এটা সম্ভব না। দুনিয়া জুড়েই চলছে যুদ্ধ। আমরা যদি একজন আরেকজনের গল্পটা শুনি তবে কি আর আমরা যুদ্ধ করতে পারবো? সব ঝগড়া-বিবাদ শেষ হয়ে যাবে।
শুধু ঝগড়া-বিবাদ নয় গল্প আসলে অসাধ্য সাধন করতে পারে। এক কথায় গল্প দুনিয়া বদলে দিতে পারে। আমরা আসলে গল্পের শক্তি বা গুরুত্ব বুঝতে পারিনা। ঠিক যেমন আমরা সারাক্ষণ বাতাসের মধ্যে থাকি তাই অক্সিজেনের গুরুত্ব বুঝতে পারিনা। কিন্তু একবার ভাবুনতো বাতাস থেকে যদি আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করতে না পারি তবে এর পরিণাম কী হবে? গল্পও ঠিক অক্সিজেনের মত। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ৬৫ শতাংশ সময় কোন না কোনভাবে গল্প বলে থাকি। আমাদের জীবন হলো অসংখ্য গল্পের যোগফল। আমরা গল্পের জন্য বেঁচে থাকি, গল্পের জন্য মানুষকে মারতে পারি এমনকি মরতেও পারি। ধর্মও এক ধরনের গল্প। ধর্মের ক্ষেত্রে কার গল্পটা সেরা বা কোন গল্পটা সবার উপরে থাকবে সেটা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে মারামারি আর হানাহানি। আবার ইতিহাসও গল্প। ইতিহাসকে যদি গল্পের আকারে পড়ানো যেত তবে আজকের দিনে ইতিহাস নিয়ে এতো বিভ্রান্তি থাকতোনা। “The Jungle Book” এবং “Mowgli: Legend of the Jungle” এর লেখক (ভারতীয়-ব্রিটিশ) Rudyard Kipling বলেছেন “If history were taught in the form of stories, it would never be forgotten.”
আমরা এমন একটা দুনিয়াতে বাস করছি যেখানে না চাইলেও আমাদের সামনে লক্ষ লক্ষ কনটেন্ট। সকালে ঘুম ভাঙ্গে মোবাইল ফোনের নোটিফিকেশনের বিপ শব্দে। রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত আপনার সামনে অজস্র কনটেন্ট। এখন প্রশ্ন হলো এসব কনটেন্টের কত শতাংশ সত্যিকার অর্থে কাজে লাগছে? আমরা কতটুকু বুঝতে পারছি এবং মনে রাখতে পারছি? হ্যাশট্যাগ যুগে কেউ কারো কথা শুনছেন না। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছেন না। আপনি আপনার সন্তানকে নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন সেটা তার কাছে তুলে ধরতে পারছেন না। শিক্ষক যা পড়াচ্ছেন স্টুডেন্টরা পরের দিন সেটা ভুলে যাচ্ছে। আপনার কাস্টমার আপনার কথা শুনছেনা, আপনিও আপনার কাস্টমারের কথা শুনছেন না। আপনি একজন উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী আপনাকে ফান্ড দিচ্ছেনা কারণ আপনি তাকে নাড়া দিতে পারছেন না। অনুদান চেয়ে দাতা সংস্থার কাছে আপনি একটা প্রেজেন্টেশন দিলেন কিন্তু তারা আপনার বক্তব্য থেকে এমন কিছু পেলনা যা দেখে আপনার প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করবে। আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানের Values Mission, Vision, Planning, Strategy ইত্যাদি সহকর্মীদের সামনে তুলে ধরে প্রেজেন্টেশন দিলেন, কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারলোনা, মনে রাখা বা প্রাকটিস করা সেটা দূরের কথা। এমনকি কয়েকদিন পর দেখা গেল প্রেজেন্টেশন এর মধ্যে কী ছিল আপনি নিজেই ভুলে গেছেন। আবার আপনার সেলস টিম পণ্য বিক্রি করার সময় এমন কিছু বলতে পারছেনা যা ক্রেতাকে আকৃষ্ট করবে। বারবার এক কথা “স্যার, কোয়ার্টার শেষ, আমিও শেষ”। এভাবে আসলে আপনার ব্যবসাও শেষ হবার পথে হাঁটতে থাকবে।
এমন পরিস্থিতি শুধু আমার বা আপনার ক্ষেত্রে ঘটছে তা নয়। বিশ্বব্যাপী মানুষ এ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সমাধান নিয়ে ভাবছেন? এ সমাধান আপনি নিজেই করতে পারেন। এর জন্য যেমন রকেট সায়েন্স জানা লাগবেনা তেমনি বিশ্বখ্যাত কোনো বিজ্ঞাপন নির্মাতা, এক্সপার্ট বা লিডারশীপ গুরু আমদানি করতে হবেনা। আপনাকে গল্প বা স্টোরি বলা শিখতে হবে। কোনো অডিও-ভিজুয়াল গল্প না বরং ওরাল স্টোরি টেলিং পারে আপনার সমস্যার সমাধান দিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে গল্প বলা। যুগে যুগে সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বদলেছে, উন্নত হয়েছে। পুরাতন মাধ্যমগুলোকে সরিয়ে মানুষ নতুন মাধ্যম গ্রহণ করেছে কিন্তু গল্পের গুরুত্ব বা কদর এতটুকুও কমেনি, বরং বেড়েছে।
আমাদের কাছে যদি পেন ড্রাইভের মত একটা যন্ত্র থাকতো যার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ভিশন অন্যের কাছে হুবহু পাঠাতে পারতাম তবে কেমন হতো? সত্যি কথা বলতে কি সে যন্ত্র কিন্তু আমাদের সবার কাছেই আছে। অবাক হচ্ছেন? গল্প বা স্টোরি হলো সেই যন্ত্র যার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বপ্নগুলো অন্যের কাছে পাঠাতে পারি। খুব শক্তিশালী এ যন্ত্রটাকে আমরা কীভাবে ব্যবহার করছি তার উপর নির্ভর করছে এর ফলাফল। ভালো কাজের পাশাপাশি খারাপ উদ্দেশ্যেও গল্পকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ঠিক পারমানবিক শক্তির মত। আপনি মানুষ মারতে পারবেন আবার মানুষের কাজেও লাগাতে পারবেন। একদিকে Steve Jobs একজন অসাধারণ স্টোরি টেইলার অন্যদিকে ওসামা বিন লাদেনও অনেক বড় স্টোরি টেইলার। আমরা কী কাজে স্টোরিকে ব্যবহার করছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে গল্পের শক্তিকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। আজকের বাস্তবতায় গল্প বলার গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু আমরা গল্পের মূল শক্তিটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধরতে পারিনা এবং এটাকে কাজেও লাগাতে পারিনা। তাই গল্পকে শুধু বাচ্চাদের জিনিস, কাল্পনিক বিষয় এবং শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখলে চলবেনা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে গল্পের ব্যবহার নিঃসন্দেহে আপনাকে অনেক অনেক এগিয়ে রাখবে।